Saturday, May 14, 2016

Life is full of surprise.

__ রাত তিনটা।

মেয়েটা ঘুমাতে পারছে না।

বিকেল থেকে কাঁদছে। কান্নার কারণ, সারা শরীর ফুলে আছে। একঝাক ভীমরুল কামড়ালে যেরকম ফুলে যায়, সেরকম।

দাতের উপর দাঁত চেপে দশ মিনিট ঘুমিয়ে ছিল। দশ মিনিট পর লাফ দিয়ে জেগে উঠেছে। মনে হচ্ছে চামড়ার নিচে এক দঙ্গল পিপড়া কিলবিল করছে।
একটা ছুরি এনে নিজের শরীরের চামড়াগুলো কুচিকুচি করে কাটতে ইচ্ছা করছে। সারা শরীরে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন লাগানোর ইচ্ছা করছে।
মেয়ের বাবা মেয়ের পাশে বসে আছে। দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। মেয়ের মা কান্নাকাটি করছে। মেয়ের চাইতে মায়ের কান্না বেশি।


মেয়ের মায়ের মোবাইল ফোনের কনট্যাক্ট লিস্ট স্ক্রোল করা হল। কোন কাজের নাম্বার পাওয়া যাচ্ছেনা। বিপদের সময় সব অকাজের জিনিস আর অকাজের মানুষ চারপাশে ঘোরে।
একটা নাম্বারে চোখ আটকে গেল..... Dr. Nazib Rangpur

-আমার মেয়ের খুব খারাপ অবস্থা নাজীব।
-কি হয়েছে?
-ওর গা চুলকাচ্ছে। চুলকাতে চুলকাতে মরে যাচ্ছে। ফুলে লাল লাল হয়ে গেছে। ওর চামড়ার নিচে নাকি পোকামাকড় হেটে বেড়াচ্ছে।
-আপনার মেয়ের বয়স কত?
-কেন?
-দরকার আছে।
-বয়স দিয়ে কি করবেন? ওর সমস্যা গা ফুলে গেছে, আপনি বয়স খুজছেন কেন?
-বয়স কত বলুন। ঝামেলা করবেন না।
-বয়স নিয়ে আপনি এতো উতলা হচ্ছেন কেন?
-এমনিই। বলবেন না?

-আপনার কাছে ফোন দিয়েছি বিপদে পড়ে-- রোগ নিয়ে। আপনি বয়স নিয়ে বাহাস করছেন?
-বাহাস করছি না। আপনার মেয়ে যদি এডাল্ট হয়, তাহলে দেখুন কোকেন নেবার অভ্যাস আছে কি না! কোকেন নিলে এমন হয়। এই রোগের নাম কোকেন বাগ। ওকে রিহ্যাবে পাঠান।
-আপনি ফাজলামি করছেন?
-না।
-তাহলে এসব বলছেন কেন?
-যাই বলি। রাত তিনটার ফোন বিরক্তিকর। কাল ফোন দিন।
-মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ নাজীব।
-হাসপাতালে ভর্তি করান। আপনি ঢাকায়, আমি রংপুরে। এখান থেকে করব কি?
-প্লিজ রাত্রে বের হতে পারব না। আশেপাশে রিক্সা, এম্বুলেন্স কিছু নেই।
-ঘাড়ে করে নিয়ে যান।
-জ্বি?
-ঘাড়ে করে নিয়ে যান।
-কি বলছেন?
-ঠিক বলছি। কোকেন খাবার সময় মেয়ের খোজ নিতে না পারলে মাঝরাতে ঘাড়ে করেই নিতে হবে। ফোন রাখুন। কাল আমার এক্সাম। ঘুমুতে হবে।
-কি করব আমরা?

-জানি না। আপাতত বসে বসে ভাবুন। পারলে এক পুরিয়া কোকেন কালেক্ট করে মেয়েকে দেন। নাক দিয়ে টেনেটেনে নেশা করুক। কোকেনগ্রস্থ রোগীদের কোকেন না পেলে এমন হয়। কোকেন নিলে সব ভালো হয়ে যাবে।
-প্লিজ! ফান করবেন না।
-আমি ফান করছি না। সিরিয়াস।
-তাহলে কি করছেন?
-আপনার মেয়ের বয়স কত?
-আট।
-এই কথাটা শুরুতেই জিজ্ঞাসা করেছি। জবাব দেন না কেন? এলার্জি আছে?
-না।
-আগে এমন হয়েছিল?
-হুম।
-কি করেছিলেন তখন?
-ডাক্তার দেখিয়েছিলাম।
-ডাক্তার কিছু খাইতে নিশেধ করেছিল মেয়েকে?
-হুম।
-কি কি?
-ডাক্তার গরু মাংস, চিংড়ি, ইলিশ মাছ, শিম, মিস্টি কুমড়ো...
-বুঝছি। আপনি বেশি কথা বলেন। বয়স বললে এতক্ষণ আপনার মেয়ে ভালো হয়ে যেত।
-জ্বী?
-জ্বী বলে দুনিয়ায় কিছু নেই। আপনার এলাকায় ঔষুধের দোকান আছে?
-আছে।
-যান। Fexofenadin ট্যাবলেট কিনে আনেন একপাতা।

রাত তিনটায় একটা মানুষ রাস্তায় দৌড়াচ্ছে। ঔষুধের দোকানগুলো বন্ধ। আশেপাশে কোন দোকান খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভদ্রলোক Dr. Nazib Rangpur নামের ছেলেটার কথায় ভরসা পাচ্ছেন না। একটা মেয়ে হাত-পা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। একটা শিম বিচির সমান ট্যাবলেট খাওয়ালেই ঠিক হয়ে যাবে?
এই ছেলে নির্ঘাত ফান করছে। আগে বয়স নিয়ে আগে বাহাস করেছে। এবার ট্যাবলেট নিয়ে বাহাস করছে। বাহাস করার জন্য মেয়েকে রেখে মাঝরাতে ঢাকা শহরের গলিতে দৌড়াতে হচ্ছে।
-নাজীব সাহেব?
-বলুন।
-ট্যবলেট পাইছি।
-পাইলে খাওয়ান। বারবার ফোন করে বিরক্ত করছেন কেন?
-কয়টা...কিভাবে খাওয়াব?
-আপাতত একটা খাওয়ান...আধা ঘন্টা পর কোন রেজাল্ট না পেলে আরেকটা খাওয়াবেন।
-দোকানদার তো অন্য কথা বলছে।
-কি বলছে?
-আপনি ১২০ বাচ্চাকে খাওয়াতে বলছেন, দোকানদার বলছে বাচ্চাদের জন্য ৬০।
-দোকানদার দেখতে কয়ফুট লম্বা?
-উচ্চতা দিয়ে কি করবেন?
-আপনার চাইতে সাইজে বড়?
-জ্বী না। পাঁচ ইঞ্চি খাট হবে...শুকনো...পাতলা।
-আশেপাশে পাবলিক আছে?
-না।
-ফার্মেসীতে আর কেউ আছে?
-না। আমি আর দোকানদার।
-একটা কাজ করেন। লোকটাকে আপনার কাছে আসতে বলেন।
-আসছে।
-খুব কাছে আসছে?
-হুম।
-একটা কাজ করেন। আপনার হাতটা বাড়িয়ে দেন।
-হ্যান্ড শেক করব?
-মাঝরাতে দোকানদারকে হ্যান্ডশেক করার কি আছে? আপনার মেয়ে তো মারা যাচ্ছে।
-তাইতো। তাহলে কি করব?
-একটা কষে চড় লাগান।
-কি বলছেন?
-আপনি চড় লাগান হারামজাদাকে। বড় ডাক্তার হয়ে গেছে। আমি বলছি ১২০, সে উল্টো ফাপড় নেয়। দেন চড়। আমি যেন শব্দ শুনতে পাই।
মেয়ের বাবার ফোনের সাইড থেকে একটা শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। কারো গালে চড় লাগালে এরকম শব্দ হয়। সম্ভবত বেশি জোরে মেরেছে। এতো শব্দ হবার কথা নয়। ডাক্তার নাজীব আয়েশ করে শব্দ শুনল।

-নাজীব সাহেব?
-আপনি বড় বিরক্ত করেন। ঘুমাতে দিচ্ছেন না কেন? কাল সকালে এক্সাম আছে।
-মেয়েকে কয়টা ট্যাবলেট খাওয়াব?
-আপাতত একটা খাওয়ান। আধা ঘন্টায় রেজাল্ট না পাইলে আরেকটা খাওয়ান।
-যদি ভালো না হয়?
-ভালো না হলে না হবে। আগে খাওয়ান।

সকাল দশটা। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। একজন সুকন্ঠি মহিলার কন্ঠস্বর।
-ডা নাজীব, আপনাকে ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ পরে। আমি ডাক্তার নাজীব নই। ডাক্তার হতে আরো এক বছর দেরি আছে।
-আমাদের কাছে আপনি ডাক্তার।
-যুক্তিহীন কথাবার্তা বলবেন না।
-বলব...হি হি হি
-হাসবেন না। মধ্যবয়স্ক মহিলার কন্ঠে বাচ্চাদের মতো খিলখিল হাসি শুনলে খারাপ লাগে।
-হি হি হি।
-কেন ফোন দিয়েছেন।
-খবর জানাতে।
-কি হয়েছে। খারাপ কিছু?
-হুম। গতকাল ট্যাবলেট খাওয়ার আধাঘন্টা পর ঘুমিয়ে গেছে। আর জাগছে না।
-কি খারাপ অবস্থা। এখন সকাল দশটা বাজে। এখনো উঠে নাই?
-না।
-নাকে হাত দেন। মরে টরে গেল নাকি?
-আজিব কথা বলেন ডাক্তার সাহেব।
-নাজীব বলবে আজিব কথা। সজীব হলে বলবে অজীব কথা। ছন্দে চমৎকার মিল আছে না?
-হুম আছে।
-বাচ্চার নাকে হাত দিছেন?
-হুম। নিঃশ্বাস নিচ্ছে না।
-একটা আয়না ধরেন নাকে।
-আয়না ধরে কি হবে? আপনি আবার ফান শুরু করছেন।
-আয়না ধরছেন?
-হুম।
-আয়নায় কি কুয়াশার মতো ঘোলা দেখা যাচ্ছে?
-হুম।
-টেনশন করবেন না। মেয়ে বেঁচে আছে। ঘুমাতে দেন।
-আপনাকে ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করবেন না। খাটো হবার জন্য আমার ভাগ্যে মেয়ে জুটছে না।
-মানে কি?
-মানে সাধারণ। মেয়ের উচ্চতা পাঁচ ফুট আট, আমারও পাঁচ ফুট আট।
-তো?
-মেয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে, আপনার উচ্চতা কত, আমি বলছি পাঁচ ফুট পাঁচ।
-এরপর?
-মেয়ে আর কথা বলছে না। আগে খুব প্রেমের জন্য মিস্টি মিস্টি কথা বলত। এখন নক করলেও কথা বলে না। গতকাল ব্লক দিয়েছে।
-হিহিহি
-বাচ্চা মেয়েদের মতো হাসবেন না। বিরক্ত লাগছে।
-আচ্ছা হাঁসব না।
-গতকাল রাতে ফোন দেন নি কেন?
-কখন?
-ঔষুধ খাওয়ানোর পর?
-মেয়ের চুলকানী আর গা ফোলা এতো দ্রুত ভালো হয়ে গেল যে ফোন দেওয়াই হল না।।
-দেবার দরকার ছিল না?
-ছিল।
-দেন নি কেন? একজাক্ট কজ বলুন।
-আসলে মেয়ে সুস্থ্য হবার পর এতো বেশি খুশি হয়েছিলাম আমরা দুজন, মেয়েকে নিয়েই সারারাত বসে ছিলাম।
-দুঃখের সময় ডাক্তারকে বারবার স্মরণ করবেন, সুখের সময় করবেন না?
-মানে?
-ধরুন একজন মেডিসিন ডাক্তারের চেম্বারে গেলেন। পাঁচশ টাকা ভিজিট আর দেড় হাজার টাকার টেস্ট করে ফেললেন। অনেক গালাগালি করলেন ডাক্তারকে। একসময় দেখলেন আপনার রোগ ভালো হল। এরপর আরেকবার তার কাছে যাওয়া উচিৎ নয়?
-আপনি কি আবার ভিজিট দিয়ে দেখা করতে বলছেন?
-না। আপনাদের মাথায় ভিজিট আর টেস্টের চিন্তা ছাড়া অন্য কিছু আসা দরকার। আপনি সুস্থ্য হলে একজন ডাক্তার কি সুস্থ্যতার খবর জানার হকদার না?
-হুম।
-মাঝেমাঝে একজন ডাক্তার রোগীর দীর্ঘ সিরিয়ালের মতো সুস্থ্য রোগীর দীর্ঘ সিরিয়ালও দেখে আনন্দ পেতে পারে। আহারে! আমার হাত দিয়ে এতোগুলো মানুষ সুস্থ্য হল এরকম একটা মানসিক শান্তির দরকার না?
-হুম।
-এটার একটা ভালো দিক হল...ডাক্তার মানসিক প্রশান্তি পাবে। প্রফেশনের প্রতি সম্মান চলে আসবে। এই সুযোগটা জনগণের করে দেওয়া উচিৎ নয়?
-জী, উচিৎ।
-ডাক্তাররা যে ভালোমানুষ এটাও জনগনের জানা দরকার।
-আপনি কি ক্রেডিট চাচ্ছেন?
-না। ডাক্তাররা ক্রেডিট নিলে আপনি স্রেফ মরে যেতেন। সারাদিন সব কাজ ভুলে আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া করতে হত।
-মানে?
-আপনার জন্মের সময় যে লোকটা আপনার মার মাথায় হাত বুলিয়ে নিশ্চিন্ত করেছে। আপনাকে ডেলিভারি করিয়েছে সুস্থ্য এবং সফলভাবে...সমস্ত জীবন আপনার অসুস্থতা দূর করেছে...করছে, টাকার বিনিময়ে অথবা বিনামূল্যে..তার জন্যে দোয়া করবেন না?
-অবশ্যই করব।
-মৃত্যুর সময় সবার আগে যাকে পাশে চাইবেন দাঁড়িয়ে থাকুক...আপনার মেয়ের অসুস্থতার সময় একহাজার ফোনের কন্ট্যাক্ট নাম্বার থেকে যে একটি মাত্র নাম্বার বেছে নিলেন, সেই মানুষটির ঋন পাঁচশ টাকার ভিজিট আর দেড় হাজার টাকার টেস্টে শোধ করতে পারবেন?
-না।
-ডাক্তাররা ক্রেডিট নেয় না।।
-বুঝছি। এবার নাজিব সাহেব, আপনি আবার বাহাস করছেন।
-জি করছি। রোগীরাই শুধু বাহাস করবে না? মাঝেমাঝে ডাক্তাররাও বাহাস করবে। রোগীকে সামনে বসিয়ে একজন ডাক্তার নিজের কষ্ট-অপমান-লজ্জা আর অসুস্থতার কথাও বলবে। আপনার মেয়েকে কি বলে ডাকেন?
-'মা' বলে ডাকি।
-আপনার রংপুর শহরে কোন আত্মীয় আছে?
-জ্বী।
-তাহলে 'মা' কে একদিন নিয়ে আসুন। তাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।
-আচ্ছা। হি হি হি...
-হাসবেন না। মাঝরাতে ট্রিটমেন্ট পাবার পর রোগী যখন ঘুমিয়েছি নিশ্চিন্তে...ডাক্তার তখনও রোগীর চিন্তায় নির্ঘুম... এই সংবাদটা 'মা'র জানা উচিৎ। আমি সামনে বসিয়ে তাকে এই গল্পটা শোনাব। ক্লিয়ার?

No comments:

Post a Comment