Wednesday, May 11, 2016

এক অস্টাদশী তরুনীর রুমে শুয়ে আছি।

___এক অস্টাদশী তরুনীর রুমে শুয়ে আছি।


মোটামুটি অভদ্রভাবে শুয়ে থাকা। শোয়ার ধরণ দেখে যে কেউ বিভ্রান্ত হবে। কারেন্ট নাই। কাঠালপাকা গরম পড়েছে। ঘেমে একাকার। গায়ের সমস্ত কাপড় খুলে উদোম হয়েছি। পরনে শুধুমাত্র অর্ধহাটু থ্রি-কোয়ার্টার সাইজের গ্যাভাডিনের ট্রাউজার।

অষ্টাদশী তরুনীর ঘরের কোনায় খাট ফেলানো। টানা খাট। তিনচারজন অনায়াসে শুয়ে থাকতে পারবে। আমি খাটের এক কোনায় শুয়ে পা দুটো আকাশমুখী করে দেয়ালে তুলে রেখেছি।
তরুণীর বাবা রহমান সাহেব কিছুক্ষন পরপর দেখতে আসছেন। ভেতরে ঢুকছেন না। দরজার বাতা ধরে উকিঝুকি দিচ্ছেন। মেয়ের শোবার ঘরে অপরিচিত তেইশ বছরের তরুন আকাশমুখী উল্টো হয়ে ঝুলে আছে, বিষয়টা কোনভাবেই মানতে পারছেন না।


ভদ্রলোক মানতে না পারলেও কিছু করার নেই। তেইশ বছরের তরুন তার কন্যার ঘরে তিনরাত থাকবে। সরকারি নির্দেশ। রহমান সাহেব নিরুপায়। তার হাতবাঁধা।
রহমান সাহেব অতিব্যস্তভাবে কিছুক্ষণ পরপর দরজায় আসছেন, একটা ছোটখাটো ধাক্কা খেয়ে আবার চলে যাচ্ছেন। ভদ্রলোককে দেখেই রোগ ডায়াগনোসিস করে ফেললাম। এই লোকের জন্মই হয়েছে স্বেচ্ছায় ধাক্কা খাবার জন্য। মেয়ে হাসবে, ধাক্কা খাবেন। এই বুঝি মেয়ে টাল্ডিবাল্ডি ছেলেদের সাথে ইটিশপিটিশ করছে। মেয়ে কাঁদবে, ভদ্রলোক আবার ধাক্কা খাবেন। মেয়ে নির্ঘাত কুকান্ড করে পেট বাধিয়েছে।
আমি ইচ্ছা করেই ভদ্রলোককে ধাক্কা দিচ্ছি। মাথা খাটে রেখে, পা দুইটা সোজা আকাশমুখী করে চিৎকার করে উঠলাম....... ঋতুউউউউউউ...

রহমান সাহেব কাছেই ছিলেন। এরাবিয়ান ঘোড়ার মতো কয়েকটা দীর্ঘ লম্ফঝম্ফ দিয়ে রুমে চলে আসলেন। দুটো লম্ফ দিলে কারো হাঁপানোর কথা নয়, রহমান সাহেব হাঁপাচ্ছেন।
আমি পা দুইটা আকাশে রেখেই উল্টো হয়ে অতিবিনয়ের সাথে বললাম,
-রহমান সাহেব?
-জ্বী স্যার?
-আপনার মেয়ে অনেক চমৎকার।
রহমান সাহেব ঢোক গিললেন।
-আপনার মেয়ের হাত অনেক চমৎকার!
ভদ্রলোক বড়সড় সাইজের ধাক্কা খেলেন। একটা তেইশোর্ধ তরুন নিশ্চয় তার অস্টাদশী বড়কন্যা সম্পর্কে জানে না। জানার কথাও নয়। না জানলে হাতের কথা কিভাবে বলছে?
-স্যার, একটি জিজ্ঞাসা আছে।
-বলুন রহমান সাহেব।
-আমার মেয়ের নাম ঋতু কিভাবে বুঝলেন?
আমি হেসে বললাম,
-আমি আরও অনেক কিছুই জানি আপনার মেয়ে সম্পর্কে।
-কি জানেন স্যার?
-বলা যাবে না। খুব গোপন।
রহমান সাহেব তেইশোর্ধ তরুনের কথা শুনে আরেকবার ধাক্কা খেলেন।
-আপনি চলে যান। বিষয়টা নিয়ে আমাকে আরেকটু ভাবতে দিন।

রহমান সাহেব পুনর্বার ধাক্কা খেয়ে চলে গেলেন। তাকে বলা হলো না, দেয়ালের ওয়ালম্যাটে চুমকি বসিয়ে 'ঋতু' নামে কারুকার্য করা। চমৎকার হাতের কাজ। ওয়ালম্যাটের নিচে মার্কার পেনে লেখা-by Ritu । এতো চমৎকার কাজ কে করেছে, তার ঠিকুজি-কুষ্ঠি জানা দরকার। নামটা দেখে ঋতু বলে চিৎকার দিয়েছি। রহমান সাহেব ছুটে এসেছেন। ভদ্রলোকের ছুটে আসা দেখেই নিশ্চিত হওয়া গেল, এটা রহমান সাহেবের পরিচিত মেয়ে। স্ত্রীও হতে পারে। তবে মধ্যবয়স্ক একটি লোক নিজের স্ত্রীকে কখনোই এত চিন্তিত হবেনা।
ঋতু নামের ওয়ালম্যাট-কন্যাটি রহমান সাহেবের স্ত্রী নাকি মেয়ে, এই দ্বিধাটা দূর করতে হবে।
ওয়ালম্যাটের নিচে ছোট্ট করে একটা কথা লেখা আছে, জন্ম সাল- ২২-১২-১৯৯৮। সাল দেখে ধারনা করা যায় মেয়ে অস্টাদশী। অস্টাদশী ঋতু নামের কোন মেয়ে রহমান সাহেবের মতো চল্লিশোর্ধ মানুষের স্ত্রী হবেন না, মেয়ে হবার সম্ভাবনাই প্রবল।
মোটামুটি গবেষনালব্ধ ফলাফল দাড়াল-
-কন্যার নাম ঋতু।
-অষ্টাদশী।

-চমৎকার শিল্পমনা মেয়ে (এই ধারনার কারণ, মেয়েটি ভালো ওয়ালম্যাট বানাতে পারে। চুমকিগুলো একটার পাশে আরেকটি নিঁখুত ভাবে বসানো হয়েছে। আঁকাবাঁকা নয়। চুমকির নিখুঁত অবস্থান দেখে বোঝা যায়, কন্যার হাত ভালো)

শিল্পসমৃদ্ধ ওয়ালম্যাটের দিকে তাকিয়ে আছি। ঋতু নামের মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছার পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি নেই। মোটামুটি যুক্তিহীন ইচ্ছা। যুক্তিহীন ইচ্ছা এক ধরণের বিভ্রান্তি। রহমান সাহেব আমাকে নিয়ে বিভ্রান্ত, আমি ঋতুকে নিয়ে বিভ্রান্ত।
ঘটনার নিগুঢ় রহস্য পাঠকদের কাছে ব্যাখ্যা করা দরকার।

রংপুর মেডিকেল থেকে তিন রাত, চারদিনের সফরে রংপুর-পলাশবাড়ি-রংপুর ভিসায় পলাশবাড়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসতে হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য বাৎসরিক সার্ভে। মেডিকেলিয় ভাষায় সার্ভের বাহারি নাম হল রেসিডেন্সিয়াল ফিল্ড সাইট ট্রেনিং (RFST)। নাম বাহারি হলেও আমাদের কোন বাহারি কাজ নেই। দুপুরবেলা গরম সূর্য মাথায় নিয়ে আশেপাশের গ্রামেগ্রামে ঘুরতে হচ্ছে। রিপ্রোডাকটিভ এজের মহিলাদের গিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে হচ্ছে। আমার জন্য নির্ধারিত প্রশ্নটি হল- বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করা,

-মা, আপনি গর্ভবতী অবস্থায় কি সিগারেট খান? যদি খান, কি ক্ষতি হয় জানেন?'
বলাবাহুল্য কোন মহিলায় এই প্রশনটি বুঝতে পারছেনা। আমি আমার গাইড সাবএসিসটেন্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার বোরহান উদ্দিন সাহেব ট্রান্সেলেট করে মহিলাকে পুনর্বার জিজ্ঞাসা করছেন, 'প্যাট হবার পর কি বিড়ি খাছনিন? বিড়ি খালি কি দুঃখু হয় জানেন গো মা জননী?
অধিকাংশ মহিলা এই প্রশ্নের জবাব দেননা।

রাত্রিবেলা সবগুলো প্রশ্নোত্তর একটি বিশাল ডেটাশীটে সাজাতে হয়। এই কাজটির জন্য তিনদিনের রুম বরাদ্দ করেছেন সরকার। অলৌকিকভাবে আমার জন্য বরাদ্দ করা রুমটি পলাশবাড়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হেড নাইট গার্ড আব্দুর রহমান সাহেবের বড় মেয়ের শয়ন কক্ষ। উল্লেখ্য- রুমটি লটারীর মাধ্যমে আমার ভাগে পড়েছে।

সারা বছর রেস্ত হাউজ ফাকা থাকায় নাইটগার্ড রহমান সাহেব গ্রাম থেকে স্ত্রী কন্যাদের রেস্ট হাউজে নিয়ে বিশাল সংসার পেতে বসেছেন। আমরা এসে পড়ায় ঘরগুলো খালি করে দিতে হয়েছে। স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে পাশের ধ্বংসস্তুপ হয়ে যাওয়া একটা পুরাতন দালানে অস্থায়ী আবাস নিয়েছেন। আমরা চলে গেলে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে আবার আমাদের রুমগুলোতে ফিরে আসবেন।

রহমান সাহেব সবকিছু নিয়ে গেছেন। যা রেখে গেছেন তা তার নিজের এবং স্ত্রীর স্মৃতি হিসাবে আছে। কন্যার সমস্ত স্মৃতি সরিয়ে নিলেও দেয়ালের ওয়ালম্যাটগুলো নিয়ে যান নি।
নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। আমার সামনেই ঋতু নাম লেখা ওয়ালম্যাট ধরে কিছুক্ষন টানাটানি করলেন। খাটো মানুষ। খুলতে না পেরে একটা পর্দা দিয়ে কন্যার নাম ঢেকে দিয়েছেন। আমি রুমে ঢুকেই পর্দাটা খুলে ফেলেছি। পর্দা সরিয়ে মোটামুটি বিস্মিত হয়েছি। ওয়ালম্যাট অসম্ভব চমৎকার। রুপালী চুমকী বসিয়ে লেখা 'ঋতু'। নীচে লাল চুমকীতে লেখা-ভুলনা আমায়!

আমি রহমান সাহেবের সামনেই পর্দা সরিয়ে ওয়ালম্যাটটা খুলে ফেললাম। রুমাল দিয়ে মুছে আবার ঝুলিয়ে রাখলাম। রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসি দিলাম।
রহমান সাহেব প্রথমবার ধাক্কা খেলেন। এরপর লাগাতার খেয়েই যাচ্ছেন।
তিনদিন কাজ হল। আজ আমাদের শেষ রাত। আগামীকাল দুপুরে আমরা ফিরে যাব। এতো চমৎকার একটা যায়গা ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে।

রাত নয়টা বাজে। আকাশে মেঘ। যেকোন মুহুর্তে বৃষ্টি হতে পারে। খাবার পানি এনে রাখতে হবে। রাতে খাবারের জন্য পানি পাওয়া যায় না। বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে। ট্যাপের পানি খাওয়া যায়না। থকথকে আয়রন।

পানির জন্য রহমান সাহেবের অস্থায়ী আবাসে গেলাম। টিউবয়েলের পানি নিতে নিতে আমি চমকে উঠলাম। ধংশস্তুপের একটা ঘর থেকে কিন্নরী কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে।
আমার ক্ষুদ্রজীবনে এত চমৎকার গলায় কোনদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি না। সুরের মুর্ছনায় আমার মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে যাচ্ছে। আমি স্থির হয়ে আছি। বিভ্রান্ত হয়ে আছি। আকাশের মেঘ আর প্রচন্ড বাতাস আমার বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আমি দুর থেকে সংগীতের উৎস রুমের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। সমস্ত দরজা জুড়ে সাদা পর্দা ঝুলছে। সংগীতের সুর-মুর্ছনায় দরজা কেঁপে কেঁপে উঠছে। দরজার পর্দা উড়ছে। পর্দার ওপাশের কিন্নরীকে দেখা যাচ্ছে না। অদৃশ্য কিন্নরী বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কলপাড়ে রহমান সাহেব আমার পাশে দাড়িয়ে আছেন। আজ সার্বক্ষণিক আমার আশেপাশে থাকার দায়িত্ব পেয়েছেন। আমি রহমান সাহেবকে কাঁচের পানিভর্তি জগটা দিয়ে বললাম,
-এই বাসায় মানুষ থাকে?
-হুম।
-একটা মেয়ে গান গাইছে, শুনতে পাচ্ছেন?
-হুম।
-সে কি আপনার মেয়ে?
-হুম।
-যে মেয়েকে বলুন, আমি তার গান শুনতে চাই। সামনাসামনি বসে শুনতে চাই। অবশ্যই আগামীকাল ভোরে নিয়ে আসবেন।

রহমান সাহেব এবার বৃহত্তম ধাক্কাটা খেলেন। হাত থেকে কাচের জগটা পড়ে ভেঙ্গে গেল।
ধাক্কা খাওয়া রহমান সাহেবকে রেখেই আমি ফিরে আসলাম। দীর্ঘ সময় রহমান সাহেব বিভ্রান্তির মাঝে বসবাস করবেন। কিন্নরী রবীন্দ্রিক অষ্টাদশীকে আমার সামনে হাজির করবেন কি করবেন না এই বিভ্রান্তি তাকে আগামীকাল পর্যন্ত বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে।
রহমান সাহেব আগামীকাল ভোরবেলা আমার খোজে আসবেন। হয়তো বাধ্য হয়ে অষ্টাদশীকে সঙ্গে আনবেন গান শোনানোর জন্য অথবা অষ্টাদশীর হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে আসবেন-বাবা, সে গান শোনাতে পারবে না।

যেকোন খোজেই আসুক না কেন-রহমান সাহেব রুমে ভীষন খুশি হবেন। অসম্ভব খুশি হবেন। যে ছেলেটা গান শুনতে চেয়েছিল সে নেই। নির্দেশ দেবার মতো কেউ নেই।
রহমান সাহেব যখন খুশি হবেন, কাকডাকা ভোরে অন্ধকার বাসের সিটে বসে আমি তখনো বিভ্রান্ত হয়ে বসে থাকব। কেন বসে থাকব জানি না। শুধু জানি কাউকে না জানিয়ে ফিরে যেতে হবে। ভোর হবার আগেই আমি ফিরে যেতে হবে।

মহান উক্তিতে বলা আছে, জীবন জানতে হলে ক্ষুধার্ত থাকো, অভাবী থাকো....
আমিও ক্ষুধার্ত থাকতে চাই, অভাবী থাকতে চাই।
আমার থাকবে কিন্নরী কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার একরাশ অভাব।

No comments:

Post a Comment